পান্তা-ইলিশ শহুরে হেঁয়ালি, বাঙালি সংস্কৃতি নয়

‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ প্রবচনটি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে অভাব-জর্জর পরিবারের অবয়ব। সেই পান্তার সঙ্গে ইলিশ জুড়ে একে মহিমান্বিত করার উৎসব আসছে সামনে। পহেলা বৈশাখ।

বিশেষজ্ঞরা ও নথিপত্র বলছে, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পহেলা বৈশাখের ‘পান্তা-ইলিশে’র কোনো দূরতম সম্পর্ক নেই। বরং পান্তার মধ্যে আছে প্রান্তিক অভাবী মানুষের কথা। গ্রাম কিংবা শহরের প্রান্তিক মানুষের একটি নিরুপায় অবলম্বন হলো পান্তাভাত।

এই প্রান্তিক মানুষরা পান্তাভাত খান স্রেফ নুন আর মরিচ দিয়ে। ইলিশ মাছ তাদের কাছে সাধ্যাতীত বস্তুতুল্য। তাদের সারা দিনের কামাই দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে একটা জাটকা মেলে না, পহেলা বৈশাখে ইলিশের স্বপ্ন দূর অস্ত। তাই অনেকে পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশকে দেখছেন বাঙালির প্রান্তিক মানুষের প্রতি উপহাস ও ব্যঙ্গ হিসেবে।

বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লেষহীনতা ছাড়াও এই পান্তা-ইলিশের হেঁয়ালি প্রভাব ফেলছে দেশের ইলিশের বংশবৃদ্ধির ওপর। ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল সময়টা ইলিশের প্রজনন মৌসুম। কিন্তু উচ্চমূল্যের লোভে অনেক ব্যবসায়ী লুকিয়ে ইলিশ শিকার করে ক্ষতির মুখে ফেলছে দেশের এই অনন্য মৎস্যসম্পদকে।

মূলত পান্তা-ইলিশ ঘিরে ইলিশের বাজারে নৈরাজ্য শুরু হয়ে যায় পহেলা বৈশাখের বহু আগে থেকে। নববর্ষ আসতে আসতে ইলিশের দাম আকাশ ছোঁয়। প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের শহুরে মানুষের মধ্যে এ ধারা প্রচল। তবে পহেলা বৈশাখ ঘিরে ইলিশের উচ্চমূল্য, কিংবা পান্তা-ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতি নয় একশ্রেণির শহুরে মানুষের হেঁয়ালি্- এসব কারণে অনেকে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ নিয়ে বিরক্ত। এ ছাড়া ইলিশের প্রজনন মৌসুম নিয়েও ভাবছে বিভিন্ন মহল।

এবার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) প্রথমবারের মতো পান্তা-ইলিশ নিষিদ্ধ করেছে। পান্তা-ইলিশ ছাড়াই পহেলা বৈশাখ উদযাপন হবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে্- উপাচার‌্য (ভিসি) অধ্যাপক এস এম ইমামুল হক ঘটা করে ঘোষণা দিয়েছেন তা।

উপাচার্য বলেন, এই প্রজনন মৌসুমে ইলিশ খাওয়া মানে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা। তাই ববির উৎসবে সব আয়োজনই থাকবে, শুধু পান্তা-ইলিশ বাদ। নাগরদোলা, মৃৎশিল্প, হস্তশিল্প, মনিহারিসহ বিভিন্ন গ্রামীণ জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে বসবে বৈশাখী মেলা। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিঠা উৎসবসহ নানা আয়োজন তো থাকছেই।

শুধু বরিশালই নয়, দেশের বিভিন্ন মহল থেকে আহ্বান আসছে পান্তা-ইলিশের রেওয়াজ পরিহারের জন্য। ফেসবুকে অনেকে পান্তা-ইলিশের বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরছেন। সরকারের তরফেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে পান্তা-ইলিশ। কেননা ইলিশের প্রজনন মৌসুম চলছে। এ নিয়ে চলছে জোর প্রচারণা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও এ বিষয়ে সচেতনতা চালাতে সচেষ্ট। টেলিভিশন, রেডিওসহ অনলাইন গণমাধ্যমে বৈশাখে ইলিশ কেনাবেচার বিপক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের লেখক-চিন্তকরা পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশকে অর্থহীন বলছেন। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ঐতিহ্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক সম্পর্ক খুঁজে পান না তারা। তারা জানান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক দিয়ে বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে এই খাবার দুটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, কখনো ছিল না। তাদের মতে, বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হতে ব্যবসায়ীরাই শহুরে নাগরিকদের কাছে পান্তা-ইলিশকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর বলেন, “পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখের খাবার নয়। আমাদের লোকবিশ্বাস্- বছরের প্রথম দিন ভালো খেলে, ভালো পরলে সারা বছর ভালো যাবে। আমাদের ছেলেবেলায় শহর কিংবা গ্রামে অন্তত পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খেতে কাউকে দেখিনি। এখনো গ্রামের বাড়িগুলোতে পহেলা বৈশাখে ভালো খাবারের চেষ্টা থাকে, পান্তা নয়।”

সৌমিত্র শেখর বলেন, “গত কিছু বছর হলো বাংলাদেশের শহরে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ‘কালচার’ দেখা যাচ্ছে। এটি সংস্কৃতির নামে লোক হাসানো, নাকি অজ্ঞতা বুঝতে পারছি না।”

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার এক লেখায় বলেন, “গরিব মানুষের খাবার পান্তাভাত। রাতে খাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত রাখার কোনো উপায় ছিল না; তাই পানি দিয়ে রাখা হতো এবং সকালে আলুভর্তা, পোড়া শুকনো মরিচ ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হতো। আমিও ছোটবেলায় খেয়েছি। কিন্তু এখন পান্তা-ইলিশ ধনী লোকের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে এবং এটা দুর্মূল্যও বটে, যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে।”

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়ও ইলিশ খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। প্রজনন মৌসুমে শখের বশে ইলিশ খেয়ে মৎস্যসম্পদ ধ্বংস না করে সরকারি নিয়ম মেনে চলা উচিত। দেরিতে হলেও বৈশাখে পান্তার সঙ্গে ইলিশ না খাওয়ার বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। তাদের আশা, এ উদ্যোগ কাজে আসবে, ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে।

উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখা গেছে, পান্তা-ইলিশ কখনোই বাঙালি সংস্কৃতির অংশ ছিল না। তবে পান্তাভাত গ্রামীণ বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি খাবার হিসেবে বিবেচিত। রাতের খাবারের জন্য রান্না করা ভাত বেঁচে গেলে সংরক্ষণের জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরদিন এই পানিতে রাখা ভাতের নাম হয় পান্তাভাত। পান্তাভাত গ্রামের অনেক মানুষ সকালের নাশতা হিসেবে খায়। সাধারণত লবণ, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ মিশিয়ে পান্তাভাত খাওয়া হয়।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে একশ্রেণির শহুরে বাঙালি বাংলা নববর্ষকে ঘটা করে উদযাপন করতে যোগ করে ‘পান্তা-ইলিশ’।

পান্তাভাতের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায়, নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাত পানিতে প্রায় এক রাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পান্তায় পরিণত হয়। ভাত মূলত পুরোটাই শর্করা (Carbohydrate)। ভাতে পানি দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারী (Fermentation) ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) বা ইস্ট (Yeast) শর্করা ভেঙে ইথানল ও ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে। এই ইথানলই পান্তাভাতের ভিন্ন রকম স্বাদের কারণ।

মূলত পান্তাভাত ভোর পর‌্যন্ত ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি। এমনিতে ভাত বেশিক্ষণ রেখে দিলে তা পচে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু পানি দিয়ে রাখলে গাজনকারী ব্যাকটেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে বলে পান্তাভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায় (pH কমে)। তখন পচনকারী ও অনান্য ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর